১০ জনের কাজ করেন ৪ জন
রাজধানীর মোড়ে মোড়ে আনসার সদস্যরা পুলিশকে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতেন। গুরুত্বপূর্ণ অনেক মোড়েই পুলিশের চেয়ে আনসার সদস্যরাই বেশি ছিলেন। কিন্তু গত ২৫ আগস্ট সচিবালয়ের সামনে ছাত্রদের সঙ্গে মারামারির পর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে আনসারদের দেখা যাচ্ছে না। শুধু ট্রাফিক নয়, বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনার নিরাপত্তায়ও জনবল সংকট দেখা দিয়েছে। ১০ জনের দায়িত্ব পালন করেন ৪ জন। এতে নিরাপত্তায় ঘাটতি থাকছে। যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের অতিরিক্ত কাজের চাপ নিতে হচ্ছে।
আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর উপপরিচালক মো. আশিকউজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সচিবালয় ঘেরাও বা যারা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের খুঁজে বের করে আটক করা হচ্ছে। তবে অনেকে এখনো আত্মগোপনে রয়েছেন। যারা নির্দোষ তাদের ভয়ের কিছু নেই। তাদের দ্রুত কাজে যোগ দিতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনের তুলনায় আনসার সদস্য কম, সেখানে নতুন আনসার নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। আশা করি দ্রুতই সমস্যার সমাধান হবে।’
রাজধানীর বাংলা মোটর মোড়ে প্রতিদিন চারজন আনসার দায়িত্ব পালন করতেন। তারা মূলত ভিআইপি বা ফার্মগেট-শাহবাগমুখী রাস্তায় যন্ত্রচালিত যানবাহন চলাচল নির্বিঘœ করতেন। অর্থাৎ রিকশা বা ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে বাধা দিতেন। তাছাড়া ট্রাফিক পুলিশ যখন কোনো যানবাহনের কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যস্ত থাকতেন, তখন আনসার সদস্যরাই ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতেন। ২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলা মোটর মোড়ে কোনো আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন না। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এ মোড়টিতে যারা ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের বাইরের জেলা থেকে এনে পদায়ন করা হয়েছে। তারা রাজধানীর জটিল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় এখনো অভ্যস্ত হতে পারেননি। আনসার বা পর্যাপ্ত ট্রাফিক না থাকায় ফার্মগেট-শাহবাগমুখী কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউতে হরদম রিকশা প্রবেশ করছে।
সরকারি দায়িত্ব পালন ছাড়াও বেসরকারি পর্যায়ে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন আনসার সদস্যরা। যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আনসার নিয়োগ করতে পারেন। প্রতিদিন আট ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের জন্য একজন আনসার সদস্যকে ৫৪০ টাকা পরিশোধ করতে হয়। বাড়তি দায়িত্ব পালন করলে তাদের অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। এই টাকার বাইরেও আনসার সদর দপ্তরকে নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন দিতে হয়। এ ছাড়া রেশন সুবিধাও আছে। আনসার সদস্যদের নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথমে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচন করা হয়। তবে প্রশিক্ষণ নিলেই যে চাকরি হবে, সে নিশ্চয়তা নেই। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে বাহিনীর পক্ষ থেকে চূড়ান্ত বাছাই করা হয়। সেই বাছাই সদস্যরাই দৈনিক চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করেন। অঙ্গীভূত হয়ে কাজের মেয়াদ হয় টানা তিন বছর। এরপর তারা যখন রিজার্ভ টাইম পার করেন, তখন এসব সুবিধা থাকে না।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের হলি ইন হোটেলে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন আনসার সদস্য রুবেল আহম্মেদ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। কিছু দাবি নিয়ে সম্প্রতি আনসার সদস্যরা আন্দোলন করেন। এ নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটায় কিছু সদস্য কারাগারে আছেন। অনেকে আত্মগোপনে রয়েছেন। আবার অনেকে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়েছেন। তাই আমাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এখন ছুটি পাওয়া যাচ্ছে না। ১০ জনের কাজ ৪ জন দিয়ে করাচ্ছে প্রতিষ্ঠান। শুধু এখানেই নয়, প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই একই অবস্থা। দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা ছুটি বা সাপ্তাহিক বন্ধ পাচ্ছেন না। বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।’
উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা পরিষদ বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন আনসার সদস্যরা। সাম্প্রতিক আন্দোলনের পর তাদের এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় বদলি করা হচ্ছে। সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার ইউএনও গোলাম মোস্তফা মুন্না দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও আনসারদের সচিবালয় ঘেরাও নিয়ে যে মামলা হয়েছে, সেই প্রভাব উপজেলা পর্যায়েও পড়েছে। দায়িত্বরত আনসারদের পরিবর্তন করে নতুনদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখানে যে আনসার সদস্যরা ছিলেন, তাদের অন্য উপজেলায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক প্রতিষ্ঠান-সংগঠনের মতো আন্দোলনে নামেন বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। দাবি আদায়ে সচিবালয় ঘেরাও করে এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান তারা। এ ঘটনায় ১০ হাজার আনসার সদস্যকে আসামি করে মামলা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৭২ জন এখন কারাগারে।
বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী দেশের সবচেয়ে বড় আধাসামরিক বাহিনী। এ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৬৩ লাখ। আনসার সদস্যরা জাতীয় দুর্যোগ বা সংকটে সরকারের হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের অনুরোধেও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। বাহিনীতে দুই ধরনের সদস্য থাকেন। একটি সাধারণ আনসার, অন্যটি অঙ্গীভূত আনসার। সাধারণ আনসার স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে থাকেন। জাতীয় দুর্যোগ বা সংকটে তাদের ডেকে আনা হয়। অঙ্গীভূত আনসার কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের অনুরোধে সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। এই অঙ্গীভূত সাধারণ আনসারের সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। এর মধ্যে ৫৫ হাজার সদস্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। বাকি ১৫ হাজার রিজার্ভ থাকেন। তারা পালাক্রমে দায়িত্ব পান। নির্ধারিত পালা শেষ হলে ‘রেস্ট টাইমে’ থাকা সদস্যদের ডেকে আনা হয়। এ ছাড়া জরুরি প্রয়োজনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে বিভিন্ন দায়িত্বেও পাঠানো হয় ‘রেস্ট টাইমের’ সদস্যদের।
রাজধানীর রমনা পার্কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন ৩৫ জন আনসার সদস্য। এ পার্কের সুমন মিয়া নামে এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগের ব্যাচের সব সদস্যই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তাদের ১১ জনই বর্তমানে কারাগারে। বাকিরা আত্মগোপনে। আমাদের নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’
রাজধানীর মিন্টো রোডে ভিআইপি ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় দায়িত্বরত আনসার সদস্য মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের একটানা তিন বছর কাজের পর বাধ্যতামূলক ছয় মাস রেস্টে থাকতে হচ্ছে। এ সময়টায় একজন আনসার সদস্যের সংসার চালাতে কষ্ট হয়। বাধ্যতামূলকভাবে রেস্টে থাকার বিষয়টি বাদ দেওয়ার জন্যই মূলত আমাদের আন্দোলন ছিল।’
রাষ্ট্র সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে আনসার বাহিনীরও সংস্কার করতে হবে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভয়ে রাখার জন্য আনসার সদস্যদের মামলা দেওয়া হয়েছে। অজ্ঞাতনামা ১০ হাজার আসামি না করে যারা জড়িত তাদের আটক করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মামলার ভয়ে অনেকে আত্মগোপনে রয়েছে, কাজে ফিরছে না। তাই আগের বা অতীতের মতো আনসারদের ব্যবহার না করে, তাদের সঠিক কাজ করার জায়গা তৈরি করে দিতে হবে।’
- দেশ রূপান্তর
